দেশব্যাপী করোনা মহামারী চলাকালে ২০২০ সালের ১১ জুন শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে ও আরাফাত রহমান কোকো মেমোরিয়াল ট্রাস্ট্রের উদ্যোগে পিপিই বিতরন করা হয়। তারেক জিয়ার পিপিই বিতরন করায় একই মাসের ২১ তারিখে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের উদ্যোগে প্রেসক্লাবে সামনে ‘প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বিএনপি নেতা এর ইদ্রিস আলীর নেতৃত্বে তথা কথিত কতিপয় সাংবাদিক জননেত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামীলীগ সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও অপপ্রচার’ র প্রতিবাদে’ প্রতিবাদ সভা ও অবস্থান কর্মসূচী পালন করে। এঘটনায় ক্লাবের সভাপতি ও কতিপয় সদস্যরা ওই প্রতিবাদ সমাবেশ ও অবস্থান কর্মসূচিতে একত্বতা প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে সভা ডেকে তারেক জিয়ার পিপিই বিতরনের অভিযোগ তুলে প্রেসক্লাবের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি এম ইদ্রিস আলিকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়। একই সাথে স্থানীয় আওয়ামীলীগের এমপির ব্যক্তিগত সহকারীকে ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি পদে বসানো হয়।
এই ঘটনার জের ধরে রোববার (১৭ নভেম্বর) শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারন সম্পাদক এম ইদ্রিছ আলী ক্লাবের সভাপতিসহ স্থানীয় আওয়ামিলীগ ও অঙ্গ সংগঠনের ৫৭ জনের নাম উল্লেখ করে শ্রীমঙ্গল থানায় একটি মামলা রুজু করেছেন।
জুলাই বিপ্লব ও পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গত ২৭ অক্টোবর শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবের এক কার্যকরী সভায় এম ইদ্রিস আলীর বহিষ্কার রাজনৈতিক বিবেচনা প্রসূত ও গঠনতন্ত্রবিরোধী হওয়ায় বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার ও সসম্মানে তার সদস্য পদ ফিরিয়ে দিয়ে রেজুলেশন পাস হয়। এরিমধ্যো ক্লাবের সভাপতি অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। সহসভাপতি সহ আরো বেশ কয়েকজন সদস্য পদত্যাগ করে কেউ কেউ গা ঢাকা দেয়ার খবর পাওয়া গেছে।
দায়েরকৃত মামলার আসামীরা হলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ মনসুরুল হক (৫২), শ্রীমঙ্গল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অর্ধেন্দু কুমার দেব যেতুল (৬০), সহ সভাপতি মোঃ আউসুফ আলী, সাধারণ সম্পাদক জগৎ জ্যোতি ধর শুভ্র (৫০), শিক্ষকনেতা জহর তরফদার (৫৫), জেলা আওয়ামীলীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক এ.এস.এম. আজাদুর রহমান আজাদ (৫২), উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক এনাম হোসেন চৌধুরী মামুন (৫৫), আকরাম খাঁন (৫৪), সাংগঠনিক সম্পাদক বেলায়েত হোসেন (৫৫), আওয়ামীলীগ নেতা সালিক আহমদ (৫৫), ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রসিদ (৬০), ইউপি চেয়ারম্যান রনেন্দ্র প্রসাদ বর্ধন (৫৫), প্রেসক্লাবের সভাপতি বিশ্বজ্যোতি চৌধুরী (৫৫), ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রলীগনেতা ইমাম হোসেন সোহেল (৪০), সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী, যুবলীগনেতা বদরুল আলম শিপলু (৫০), সাংবাদিক দীপংকর ভট্টাচার্যা লিটন (৪৮), ছাত্রলীগনেতা দেলোয়ার হোসেন রাহীদ (৪২), আকবর হোসেন শাহীন (৪০), আলী আমজন ইমরান (৩৮), সাংবাদিক এস,কে দাস সুমন (৩৫), উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মসুদুর রহমান মসুদ (৩৫), যুবলীগ নেতা আবু তালেব বাদশা (৪৫), শের জাহান আলী সেজু (৪০), ইউপি সদস্য মোঃ লিমন মিয়া (৩৯), সাংবাদিক হৃদয় দাশ শুভ (৪০), যুবলীগ নেতা মনির মিয়া (৫০), তামিম আহমদ (৩৫), স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা হারুন মিয়া (৪০), ছাত্রলীগনেতা আইবুর রহমান আকাশ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা এ.এফ.এম হিমেল (৪০), ছাত্রলীগ নেতা নাইম (২৫), উজ্জল কান্তি দাশ (৩০), সাদিকুল ইসলাম (২৬), আকরামুল হক সোহাগ, যুবলীগনেতা পঙ্কজ দেবনাথ (৪৬) সোহাগ (৩৫), আওয়ামীলীগ নেতা কামরুল হাসান দোলন (৫০), যুবলীগ নেতা শফিকুল ইসলাম জাবেদ (৩৮), উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক রাজু দেব রিটন (৩৮), ছাত্রলীগ নেতা খায়রুল আলম কায়েস (৩৮), মুসাহিদ চৌধুরী (৩৩), যুবলীগ নেতা নকুল দেবনাথ, সিহাব মিয়া (৩৮), সাজু মিয়া, সাইদুল ইসলাম মুহিত (৩৫) নাসির মিয়া (৪২), পৌর ছাত্রলীগনেতা আবেদ হোসেন (৩৭), সাংবাদিক মামুন আহমেদ (৫৫), পৌর আওয়ামালীগনেতা তহিরুল ইসলাম মিলন (৫২), সাবেক ছাত্রলীগনেতা মমিনুল হোসেন সোহেল (৫০), সাংবাদিক ভাস্কর হোম চৌধুরী (৪৮), সাংবাদিক সনেট দেব চৌধুরী (২৮), যুবলীগনেতা সিরাজ উদ্দিন তালুকদার সুমন (৪০) ও যুবলীগ নেতা মোঃ হারুন মিয়া (৪৫)।
এছাড়া মামলায় আরো ৫০-৬০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।
মামলার এজহারে বাদী জানান-
‘শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবের দুই বারের সাধারণ সম্পাদক (২০১৬-২০২১ইং) হিসেবে আমি দৈনিক আমার দেশ ও দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলাম। আসামীগন সকলেই আওয়ামীলীগ ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ এবং ফ্যাসিষ্ট খুনি শেখ হাসিনার দোসর। আসামী প্রেস ক্লাবের সভাপতি হইলেও তিনি স্থানীয় আওয়ামীলীগ অঙ্গ সংগঠনের সকল অপকর্মের সহযোগী ও মদদদাতা ছিলেন এবং তার সঙ্গে অপরাপর আসামীগণও আসামীগণের বিভিন্ন অপকর্মের সহযোগী ছিলেন। আসামীগণ শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভূনবীর সিন্দুরখান, মির্জাপুর ও কালাপুর ইউনিয়ন সহ বিভিন্ন স্থান হইতে অবৈধ ভাবে সিলিকা বালু উত্তোল করিয়া কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করিলে এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করিলে এবং শ্রীমঙ্গল শহয় ব্যাটারী চালিত টম টম হইতে লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা আদায় সহ জমিজমা দখল, সরকারি বরাদ্দ লুটপাট বিভিন্ন অপকর্মের বিষয়ে আমি মৌলভীবাজার ও শ্রীমঙ্গলে আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভাসহ বিভিন্ন পর্যায়ে উক্ত বিষয়ে প্রকাশ্যে অবগত করিলে আসামীগণ আমার উপর ক্ষিপ্ত হইয়া উঠে এবং আমার ক্ষতি করার পায়তারায় লিপ্ত হয়।’
মামলার এজাহারে আরো বলা হয়-
‘এ অবস্থায় ২০২০ইং সনে সারা বিশ্বে করোনা মহামারী শুরু হইলেবিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানের নির্দেশে ও আরাফাত রহমান কোকো মেমোরিয়াল ট্রাস্ট্রের কো-অরিনেটার সরফরাজ আহমেদ সরফু এর অর্থিক সহযোগীতায় শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবে স্থানীয় ধর্মীয় নেতাদের মাঝে করোনার পিপিই বিতরণ করা হয়। একারনে আসামীরা আমার ক্ষতি করার জন্য নানান ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং আমাকে প্রকাশ্যে হুমকি প্রদর্শন করিতে থাকেন।’
বাদী তার এজাহারে বলেন-
‘এ ঘটনার জের ধরে ২১ জুন তারিখে ক্লাবে অবস্থানকালে ”প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বিএনপি নেতা এম ইদ্রিস আলীর নেতৃত্বে জননেত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামীলীগ সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও অপপ্রচারের প্রতিবাদে” প্রতিবাদ সভা ও অবস্থান কর্মসূচী সম্বলিত ব্যানার টাঙ্গিয়ে রাখা হয়। পরে আসামীগণ শহর থেকে একটি জঙ্গি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে প্রেস ক্লাবের সামনে আসিয়া আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে প্রেসক্লাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে পিপিই বিতরণ করার জন অভিযুক্ত করে। এক পর্যায়ে আসামীগণ এলোপাতারি ককটেলের বিস্ফোরন ঘটায় এবং সঙ্গে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে এলোপাতারি ফাঁকা গুলি বর্ষন করে এলাকায় ত্রাসের রাজস্ব কায়েম করে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এসময় আমাকে ও আমার সঙ্গে থাকা সাক্ষীগণকে হত্যায় উদ্দেশ্যে প্রেস ক্লাবের ভিতরে ককটেল বিস্ফোরন ঘটায় এবং প্রেস ক্লাবের মূল ফটকে তালা মারার উদ্দ্যোগ নিলে পরিস্থিতি বেগতিক দেখিয়া আমি ও সাক্ষীগণ প্রেসক্লাবের পেছনের দিক দিয়া পালাইয়া আত্মরক্ষা করি। এরপর আসামীগণ প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ ও বিক্ষোভ করে সম্পূর্ণ বেআইনী ভাবে আমাকে সাধারণ সম্পাদকের পদ হইতে অপসারন ও প্রেসক্লাবের সাধারণ সদস্য পদ হইতে আজীবন বহিষ্কারের আল্টিমেটাম দেয়। এসময় শ্রীমঙ্গল উপজেলায় আমাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। ঐ দিনই রাতে প্রেস ক্লাবের কার্যকরী কমিটি পদধারী আওয়ামীলীগের দোসর সাংবাদিকরা প্রেস ক্লাবের কার্য্যকরী কমিটির সভা ডেকে আমাকে সাধারণ সম্পাদকের পদ হইতে সাময়িক ভাবে অব্যাহতি দেয় এবং আমার বরাবরে নোটিশ প্রেরণ করে। আমি কারণ দর্শানো পরও সম্পূর্ণ মিথ্যা ও মনগড়া বক্তব্য উল্লেখ করিয়া ফ্যাসিষ্ট হাসিনা সরকারকে খুশি করার জন্য সম্পূর্ণ বেআইনী ভাবে আমাকে ২৫/০৭/২০ইং তারিখে সাধারণ সম্পাদকের পদ সহ প্রেস ক্লাবের সাধারণ সদস্য পদ হইতে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে। প্রেস ক্লাবের কার্যকরী কমিটির ১ম যুপ্ত সম্পাদককে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করে শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবকে আসামীগণ ফ্যাসিষ্ট আওয়ামীলীদের দলীয় কার্যালয় বানিয়ে সেখানে নানা অপকর্ম চালাইয়া যাইতে থাকে।
আমি ঐ দিনই শ্রীমঙ্গল থানায় গিয়া তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকতাকে অবহিত করে মামলা করিতে গেলে পুলিশ আওয়ামীলীগ সরকারের প্রভাবশালী আসামীদের বিরুদ্ধে মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
প্রেসক্লাবের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি (আাসামী) বিদেশ চলিয়া যাওয়ার পর বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কার্যকরী কমিটির সভার সিদ্ধান্তে আমাকে ক্লাবের গঠনতন্ত্র বিরোধী ও বেআইনী ভাবে করা সাধারণ সম্পাদকের পদ ও সাধারণ সদস্য পদ হইতে অব্যাহতি ঘোষনা করায় গত ২৭/১০/২৪ইং আমাকে প্রেস ক্লাবের সাধারণ সদস্য পদে পুনর্বহাল করা হয়। বৈষম্য বিরোধী ছাত্রজনতার আন্দোলনের ফলে বর্তমানে অন্তবর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এবং দেশে আইনের শাসন পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ও আমি জরুরী প্রয়োজনে আমেরিকা চলিয়া যাওয়ায় আমেরিকা থেকে ফিরে এসে আপনার থানায় উল্লেখিত কর্মকান্ডের বিষয়ে আসামীগণের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করিলাম।’
শ্রীমঙ্গল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এঘটনায় রোববার রাতেই ভাস্কর হোম চৌধুরী নামে এক সাংবাদিককে আটক করা হয়েছে। বাকি আসামীদের ধরতে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।